প্রসঙ্গ : সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা
মুন্সী ফারুক আহমেদ
ইতোমধ্যে কেউ কেউ আমাকে প্রশ্ন করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে-‘সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা আবার কি? প্রশ্নকর্তা বন্ধুদের প্রতি এ বিষয়ে আমি কিছু কথা বলতে চাই। ১৯৭১ সন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙলার মানুষ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের মানে কি? মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে একটা জাতির পরাধীনতা থেকে মুক্তির লড়াই। একটি জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াই। পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন দেশের পতাকা উত্তোলন এবং নতুন জাতীয় সংগীত রচনা। সেই একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্যে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে। তখন আমার বয়স মাত্র বারো- তেরো বছর। তখন রাজনীতির কিইবা বুঝতাম! তবুও শ্লোগান দিতাম-‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন করো; পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা! ‘জয় বাংলা’ ইত্যাদি।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বারো-তেরো বছরের কিশোর। সেই সব দেশপ্রেমিক কিশোরদের মহান পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করার জন্যে আমিও ছুটে গিয়েছিলাম ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ‘ মাছিমারা ক্যাম্পে’। কিন্তু সেই ক্যাম্পের দায়িত্ব প্রাপ্তরা আমাকে দেশে ফিরে মুক্তিযোদ্ধাদের নানা কাজে সহযোগীতা করতে পরামর্শ দিলেন। আমি ফিরে এলাম। যেমন পরামর্শ তেমনই কাজ। আমাদের অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের নানা কাজে সহযোগীতা শুরু করলাম। যেমন- মুক্তিযোদ্ধাদের এক ক্যাম্পে থেকে অন্য ক্যাম্পে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেয়া, তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের সম্পর্কে নানা খবর সংগ্রহ করে দেয়া থেকে শুরু করে কতো রকমরে দায়িত্ব পালন করেছি; এসব আজ কেবলই স্মৃতি কথা।
মনে রাখতে হবে ১৯৭১ সনে জামায়াত-রাজাকার-আলবদর-আলশামস ব্যাতিত আর বাকী সব বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধের, মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে ছিলেন। যারা ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে অস্ত্র হাতে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন তারা যেমন বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধা, তেমনি-যারা দেশের ভিতর জীবনের সমস্ত ঝুঁকি নিয়ে, মৃত্যুকে নিশ্চিত জেনেও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে থাকা-খাওয়া, টাকা-পয়সা সহ সকল বিষয়ে সহযোগীতা করেছেন তাদেরকে আমরা কি বলবো? দেশের ভিতর যদি স্বাধীনতাকামী মানুষেরা সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় না দিতেন তাহলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কি দশা হতো একটু ভাবুনতো। আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অস্ত্র হাতে যারা যুদ্ধ করেছেন তারা যেমন মুক্তিযোদ্ধা, তেমনি যারা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোহগীতা করেছেন তারাও মুক্তিযোদ্ধা। তবে তাদেরকে সহযোহগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে চাই।
মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতাকামী বাঙালি প্রত্যেকে যার যার অবস্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। যেমন একজন নারী রান্না-বান্না করে মায়ের মমতায় তাঁর আঁচলে মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে; একজন কবি কবিতা লিখে; একজন গীতিকার গান লিখে; একজন গায়ক গান গেয়ে; একজন ডাক্তার চিকিৎসা সেবা দিয়ে; একজন চলচ্চিত্রকার চলচ্চিত্র নির্মান করে; একজন নাট্যকার নাটক নির্মান করে; একজন অভিনেতা -অভিনেত্রী অভিনয় করে মুক্তিযুদ্ধকে চূড়ান্ত পরিনতির দিকে নিয়ে গিয়েছেন, তাদেরকে কি বলবো? মুক্তিযোদ্ধা নাবলিঅন্তত: সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা বলেতো সম্মান জানতে পারি।
এমন সম্মান জানাতে পারলেই-আমাদের দেশে জন্ম নেবে আরো অনেক অনেক দেশপ্রেমি-গুনি মানুষ।